প্রচলিত রােগ ও সুরক্ষা

মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা কেন হয়?

তলপেটে ব্যথা মেয়েদের মাসিক অথবা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডের সময় সবচেয়ে বেশি ভোগায়। খুব কম নারীই আছেন যাদের একবারও এই পেট ব্যথা হয়নি। কিন্তু এই ব্যথা কেন হয় তা কি আমরা জানি? আর এই ব্যথা কতটুকু পর্যন্ত হওয়া স্বাভাবিক? চলুন জেনে নেওয়া যাক। 

পিরিয়ডের ব্যথা হয় জরায়ুতে সংকোচনের কারণে, পিরিয়ড শুরু হওয়ার ঠিক আগে দিয়ে। তলপেটে ব্যথা হওয়া তাই খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এই ব্যথা খুব তীব্র হতে পারে। এর পেছনের কারণগুলো চলুন জেনে আসি।

মাসিকে সময় জরায়ুর সংকোচন হয় প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক হরমোনের মাধ্যমে। যাদের শরীরে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের মাত্রা বেশি তাদের তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়।

অন্যদিকে কারো কারো কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই এই তীব্র ব্যথা হয়। তবে অনেকের এই গুরুতর পিরিয়ডের ব্যথা কোনো অন্তর্নিহিত অসুস্থতার লক্ষণও হতে পারে।

যেসব অসুস্থতার কারণে তীব্র মাসিকের ব্যথা হয়, সেগুলো হলো:

১। এন্ডোমেট্রিওসিস:

এন্ডোমেট্রিওসিস একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যেখানে জরায়ুর কোষগুলো জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পায়। এর সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ হলো কোমর ও তলপেটে ব্যথা (পেলভিক পেইন)। এর সাথে হতে পারে মাসিকে ভারী রক্তক্ষয়, সাত দিনের বেশি পিরিয়ড, দুটো মাসিকের মাঝে রক্তপাত, পেটে ব্যথা, সহবাসের সময় ব্যথা, এবং গর্ভধারণে সমস্যা।

২। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS):

সন্তানধারণে সক্ষম নারীদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন PCOS নামক হরমোনজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে রোগীদের শরীরে এন্ড্রোজেনের (পুরুষদের হরমোন) উচ্চ মাত্রা এবং অনিয়মিত পিরিয়ড হতে দেখা যায়। মাসিকে ভারী রক্তক্ষয়, সাত দিনের বেশি পিরিয়ড, মুখ এবং শরীরের অতিরিক্ত চুল, ওজন বৃদ্ধি এবং ওজন কমানোর সমস্যা, ব্রণ, চুল পাতলা হওয়া বা চুল পড়া, ত্বকের কালো দাগ বিশেষ করে ঘাড় এবং কুঁচকির অংশে কালো দাগ হলো PCOS-এর লক্ষণ।

৩। ফাইব্রয়েড:

জরায়ুর ভিতরের মায়োমেট্রিয়াম নামক জায়গায় বীজের মতো ছোটো থেকে শুরু করে বৃহদাকার ফাইব্রয়েড তৈরি হতে পারে।  লক্ষণ ছাড়াই আপনার এক বা একাধিক ফাইব্রয়েড থাকতে পারে। তবে উপসর্গ দেখা দিলে, সেগুলোর ধরণ এবং তীব্রতা নির্ভর করে ফাইব্রয়েডের সংখ্যা, তাদের আকার এবং অবস্থানের ওপর।

তলপেটে তীব্র ব্যথা ছাড়াও ফাইব্রয়েডের কারণে কোমরে ব্যথা, পিঠ ব্যথা, পা ব্যথা, মাসিকে ভারী রক্তক্ষয়, সাত দিনের বেশি পিরিয়ড ইত্যাদি হতে পারে।

৪। পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ (পিআইডি):

পিআইডি হলো নারীর প্রজনন অঙ্গে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। এটি সাধারণত যৌনমিলনে সংক্রমিত রোগ, যেমন ক্ল্যামাইডিয়া বা গনোরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয়। কোমর ব্যথা এই রোগের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ। যৌনমিলনে ব্যথা, যৌনমিলনের সময় বা পরে রক্তপাত, দুর্গন্ধযুক্ত যোনি স্রাব, প্রস্রাব করার সময় জ্বালা পোড়া, জ্বর, মাসিক হওয়ার আগে পরে ছোপ ছোপ রক্ত পড়া–এসবই পিআইডির আরো কিছু লক্ষণ।

৫। সার্ভাইকাল স্টেনোসিস:

সারভাইকাল স্টেনোসিস, যার অর্থ বন্ধ যোনিপথ। এতে আপনার সার্ভিক্স বা যোনিপথ সরু বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। যে কেউ সারভাইকাল স্টেনোসিস নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারেন কিংবা বয়সের সাথেও এই অবস্থা তৈরি হতে পারে।

এই রোগে আপনার শরীর থেকে ঋতুস্রাবের রক্ত ​​বের হতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে, যার কারণে মাসিক খুব হালকা বা অনিয়মিত হয়। সারভাইকাল স্টেনোসিসের কারণে প্রজনন সমস্যাও হতে পারে।

৬। অ্যাডেনোমায়োসিস:

অ্যাডেনোমায়োসিসে জরায়ু ফুলে ওঠে। এই ক্ষেত্রে সবসময় উপসর্গ দেখা যায় না। তবে এর কারণে আপনি তীব্র তলপেটে ব্যথা অনুভব করতে পারেন যা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং সেইসাথে মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত বা দীর্ঘায়ত মাসিক হতে পারে।

৭। জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি  (IUD):

IUD হলো একটি ছোটো জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা আপনার জরায়ুতে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন ধরনের IUD পাওয়া যায়, এদের কোনো কোনোটিতে হরমোন থাকে আবার কিছু থাকে হরমোন-মুক্ত। IUD সম্পূর্ণ নিরাপদ, কিন্তু মাঝে মাঝে এটির কারণে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে–যার মধ্যে রয়েছে: তীব্র মাসিকের ব্যথা, অনিয়মিত মাসিক এবং মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত।

আইইউডি ঢোকানোর সময় আপনার জরায়ুতে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করার ঝুঁকিও রয়েছে, যার ফলে পিআইডি হতে পারে আবার কখনো কখনো আইইউডি সরে যেতে পারে। এসব কারণেও কোমর ব্যথা হতে পারে। 

নারীদের ক্ষেত্রে “মাসিকের সাথে ব্যথা হবেই, তীব্র হলেও তা সহ্য করে নিতে হবে”–এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসাটা খুব জরুরি। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য তার নিজের জন্য, তার সন্তান এবং সর্বোপরি তার পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাসিকের সময় ব্যথা যদি অনেক বেশি হয় এবং তা যদি নিয়মিতই হতে থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সম্পর্কিত পোস্ট

আরও আরও...আর পাওয়া যায়নি.